![]() |
Picture: Arab Leaders (Internet) |
গাজায় চলছে ২১ শতকের সবচেয়ে নিষ্ঠুর, নির্মম ও পরিকল্পিত গণহত্যা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের একটি সশস্ত্র অভিযানের জবাবে ইসরায়েল যে মাত্রায় সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা যে কোনো মানবিকতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না এই দমননীতি থেকে। হাসপাতাল, স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ও সেচ্ছাসেবী মানবাধিকার কর্মী, সবই ইসরায়েলি স্থলাভিজার এবং বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এটিকে এককথায় ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত গাজায় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার শিশু, ৩৯ হাজারের বেশি শিশু অনাথ, আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার, এবং গাজার ৯০ শতাংশ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত। এটি নিছক কোনো যুদ্ধ নয়; এটি একটি একতরফা হত্যাযজ্ঞ, যেখানে অস্ত্রহীন সাধারণ মানুষ একটি পরাশক্তিধর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার।
এই বাস্তবতায় গোটা বিশ্ব যখন ন্যায় ও মানবতার পক্ষে রাস্তায় নেমেছে, তখন আরব বিশ্বের নিস্তব্ধতা অনেক বড় প্রশ্ন তুলে ধরেছে। ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে এতটাই দ্বিধান্বিত বা নিরুৎসাহী কেন আরব নেতারা?
বলা হয়, আরবরা আজ নির্লিপ্ত। কিন্তু ইতিহাসে এমনটা সবসময় ছিল না। ফিলিস্তিন প্রশ্নে আরব বিশ্বের একাধিকবার সশস্ত্র জড়িত থাকার প্রমাণ আছে। যেমন ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিসর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যৌথভাবে যুদ্ধ করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল সদ্য ঘোষিত ইসরায়েল রাষ্ট্রকে প্রতিরোধ করা এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকটে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল এক ধাক্কায় গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গোলান হাইটস দখল করে নেয়। ১৯৭৩ সালে ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে মিসর ও সিরিয়া আবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তবে প্রতিটি যুদ্ধেই দেখা গেছে একটি ব্যাপার—আরবদের মধ্যে নেতৃত্বের সংকট, কৌশলগত বিভ্রান্তি এবং পারস্পরিক আস্থাহীনতা। এসব দুর্বলতাই যুদ্ধগুলোকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারেনি।
বর্তমানে আরব রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান অনেকটাই বদলে গেছে। অধিকাংশ রাষ্ট্র এখন রাজতন্ত্র বা স্বৈরশাসনের আওতায় পরিচালিত হয়। এই সরকারগুলো তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অনেকাংশে নির্ভরশীল পশ্চিমা শক্তির উপর—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্র আবার ইসরায়েলের প্রধানতম মিত্র। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়া মানেই যুক্তরাষ্ট্রকে বিরূপ করা। এটি আরব নেতাদের জন্য কৌশলগত ও রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে। এ কারণেই তারা মানবতা ও ন্যায়ের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিতে ভয় পান।
আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়ায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এই অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে এখনো তেলনির্ভর। ফলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিক্রিয়ার শঙ্কায় তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী নয়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইতিমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এমন অবস্থায় গাজা ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নেওয়া তাদের কূটনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
হামাসকে ঘিরে আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে স্পষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব। মিশরের দৃষ্টিতে হামাস শুধু ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন নয়, বরং মুসলিম ব্রাদারহুড সংশ্লিষ্ট একটি চরমপন্থী গোষ্ঠী, যেটি তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও হামাসকে পুরোপুরি সমর্থন করে না। বরং তারা এই গোষ্ঠীকে ইরানঘনিষ্ঠ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। তাই গাজায় চলমান মানবিক সংকটে তারা এক ধরনের কৌশলগত নীরবতা বজায় রেখেছে—যাতে নিজেদের অভ্যন্তরে উত্তেজনা না বাড়ে এবং পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট না হয়।
আরব বিশ্বের বর্তমান সংকটে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাব। একদিকে কাতার, ইরান ও তুরস্কের মতো দেশগুলো হামাসকে প্রকাশ্যে সমর্থন করছে, অন্যদিকে সৌদি আরব, মিশর ও আমিরাত অনেকটাই নিরপেক্ষ কিংবা নীরব ভূমিকায় রয়েছে। এর পেছনে যেমন রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হিসাব, তেমনি রয়েছে জিওপলিটিকাল এবং অর্থনৈতিক চাপের বাস্তবতা।
এই বিভক্তির কারণে ফিলিস্তিন সংকটে আরব দেশগুলো একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে হাজির হতে পারছে না। অথচ ইতিহাস বলছে—যদি আরব রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে একজোট হতে পারত, তবে যুদ্ধ ছাড়া আরও অনেক কৌশলেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কার্যকর অবস্থান নেওয়া সম্ভব হতো।
প্রয়োজনে তারা সরাসরি যুদ্ধে না গিয়েও বেশ কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারত। যেমন—গাজায় জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা পাঠানো, আন্তর্জাতিক মহলে সংগঠিত কূটনৈতিক চাপ তৈরি করা, কিংবা ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করে একটি দৃঢ় বার্তা দেওয়া—এসব কিছুই তাদের হাতে ছিল। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব কোনোটিই তারা করছে না। এমনকি আরব লীগের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো অবস্থান বা পরিকল্পনা সামনে আসেনি।
২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর রিয়াদে আয়োজিত এক যৌথ আরব-ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে এই সংকটে একটি সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো কীভাবে এবং কোন কৌশলে এই সংকট মোকাবিলা করবে—সে বিষয়ে কোনও স্পষ্ট রূপরেখা বা ঐক্যমত্য গড়ে উঠেনি। সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে ইসরায়েলকে চলমান মানবিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করা হলেও, তাতে কার্যকর কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ বা কৌশলগত সিদ্ধান্ত উঠে আসেনি।
এর ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অবস্থানে পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও ইরাক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করলেও, উপসাগরীয় আরব দেশগুলো, মিশর ও জর্ডান তাদের বক্তব্যে অনেক বেশি সংযত ও কৌশলগত অবস্থানে ছিল। এমনকি সিরিয়া ও জর্ডানের মতো দেশগুলো, যারা একসময় ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরব ছিল, তারাও এবার অনেক বেশি সতর্ক ও পরিমিত ভঙ্গিতে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করে।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হোক বা ইউরোপ-আমেরিকার রাজপথ, সাধারণ মানুষ গাজার পক্ষে সোচ্চার। আফ্রিকার শহরগুলোতেও মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু আরব বিশ্বের নেতৃত্ব—যারা ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের পাশে থাকার দাবি করে—তারা এখন শুধু উদ্বেগ প্রকাশ করেই থেমে থাকছে। মানবতার কথা বললেও, বাস্তবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে না।
গাজায় একের পর এক হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস হচ্ছে। পানি, বিদ্যুৎ, ওষুধ—সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ যেসব রাষ্ট্র এক সময় নিজেদের ‘উম্মাহ’র নেতা দাবি করত, সেই আরব রাষ্ট্রগুলো এখন চুপ। তারা বিবৃতি দিচ্ছে, তীব্র নিন্দা করছে, কিন্তু কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এটা শুধু কূটনৈতিক বা রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, এটা এক ধরনের নৈতিক পতনও।
নিজেদের স্বার্থ, নিরাপত্তা, অথবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ঠিক রাখার অজুহাতে আরব নেতৃত্ব যদি এক জাতির নিধনের সময় নিশ্চুপ থাকে, তাহলে সেটা শুধুই ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়—তারা নিজেদের ইতিহাসকেও প্রতারণা করছে। ফিলিস্তিন ইস্যু শুধু রাজনৈতিক সংকট নয়, এটা মানবিক সংকট। এই অবস্থায় নিরবতা মানে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সমর্থন।
আজকের আরব নেতৃত্ব হয়তো যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য শক্তিধর দেশের চাপ সামলে চলতে চায়, কিন্তু ইতিহাস এমন নিষ্ক্রিয়তাকে ক্ষমা করবে না। সাধারণ মানুষ যখন মৃত শিশুদের ছবি দেখে চোখের পানি ফেলছে, তখন আরব নেতাদের চুপ করে থাকা ভবিষ্যতের প্রজন্মের চোখে এক লজ্জাজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।