Saturday, 7 June 2025

কুরবানির আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য


ইসলামে কুরবানি কেবল একটি ধর্মীয় ইবাদত নয়, বরং এটি মানবজীবনের জন্য এক আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বিস্ময়কর আত্মত্যাগ, তাঁদের আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য, এবং অন্তরের তাকওয়ার যে দৃষ্টান্ত ইসলাম বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করে—তাই কুরবানির মূল শিক্ষা। এটি কোনো পশু জবাইয়ের আচার নয়, বরং একান্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ত্যাগ ও আত্মসমর্পণের বহিঃপ্রকাশ।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর জন্ম এমন এক সমাজে, যেখানে মূর্তিপূজা ছিল সামাজিকভাবে গৃহীত ও ধর্মীয় রূপে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর পিতা আযর ছিলেন একজন মূর্তি নির্মাতা। এমন প্রেক্ষাপটে তিনি দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যান তাওহীদের পক্ষে। কুরআনে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তিনি যুক্তি ও প্রজ্ঞা দিয়ে তাঁর কওমকে প্রশ্ন করেন, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন, আর দেখান যে যেসব জিনিস সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্র ইত্যাদি—সেগুলোর ক্ষণস্থায়ী সত্তা কখনো উপাসনার উপযোগী হতে পারে না। একমাত্র সেই সত্তাই উপাসনার যোগ্য, যিনি চিরস্থায়ী, অদৃশ্য, সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান—তিনি আল্লাহ।

এই বিশ্বাসের প্রয়োগ দেখা যায় তাঁর জীবনে। নমরূদের বিশাল অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস, কিংবা প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কে কুরবানির জন্য প্রস্তুত হওয়ার ঐতিহাসিক মুহূর্ত—সবই প্রমাণ করে যে হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর বিশ্বাস ছিল কেবল কথার নয়, কাজের, আত্মনিবেদনের। কুরআনে হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে ‘খলিলুল্লাহ’—আল্লাহর বন্ধু বলা হয়েছে। আর এ বন্ধুত্ব এসেছে তাঁর তাওহীদের প্রতি অবিচলতা, আত্মত্যাগ ও আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতার মাধ্যমে। আজও মুসলিম উম্মাহর জন্য তাঁর জীবন হয়ে আছে এক প্রেরণার উৎস, এক চিরন্তন আদর্শ।



কুরবানির অন্তর্নিহিত মূল শিক্ষা হলো—আল্লাহর আদেশের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য। কুরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহর নিকট পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ, ২২:৩৭)। এই আয়াত স্পষ্ট করে দেয় যে কুরবানি কোনো বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তা অন্তরের খাঁটি ইচ্ছা, নিষ্কলুষ ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধের এক অনুপম বহিঃপ্রকাশ। জীবনের প্রিয় বস্তুকেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করতে শিখিয়ে দেয় এই ইবাদত। মানুষকে আত্মসংযম, ধৈর্য ও নির্মোহতার অনুশীলনে অভ্যস্ত করে তোলে।

তবে কুরবানির গুরুত্ব কেবল আধ্যাত্মিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়। বাংলাদেশে কুরবানির মৌসুম ঘিরে গড়ে ওঠে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক চক্র, যার প্রভাব দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি বছর ঈদুল আজহায় প্রায় এক কোটি পশু কুরবানির জন্য বাজারে আসে—গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া। এ বিপুল সংখ্যক পশু প্রস্তুত করতে বছরের শুরু থেকেই কৃষক ও খামারিরা নেমে পড়েন যত্ন ও পরিকল্পনায়। দেশজুড়ে সক্রিয় রয়েছে প্রায় এক লাখ ছোট-বড় খামার। এই খাত জুড়ে কাজ করে লাখ লাখ মানুষ—পশু খাদ্য উৎপাদন, চিকিৎসা, খামার ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে বিক্রয় ও বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে।

কুরবানির সময় দেশের শহর ও গ্রামে বসে হাজারো অস্থায়ী পশুর হাট। এসব হাটে ঘটে বিশাল অংকের আর্থিক লেনদেন, বাড়ে পরিবহন খাতে চাহিদা। ট্রাক, পিকআপ, ভ্যান এমনকি নৌপথেও পশু পরিবহনে ব্যস্ত সময় কাটায় হাজার হাজার শ্রমিক। পাশাপাশি হাট ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয় নিরাপত্তাকর্মী, সেবাকর্মী ও অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকেরা। পশু কেনাবেচার এই পুরো চক্রই দেশের অর্থনীতিকে দেয় এক তাৎক্ষণিক গতি।

এছাড়া কুরবানির সময় একাধিক খাত হয়ে ওঠে সরাসরি লাভবান। কসাই পেশার লোকজনের আয় কয়েকগুণ বাড়ে; মাংস কাটা, সংরক্ষণ, বিতরণ এবং হিমায়নের কাজ করে বহু মানুষ। দড়ি, ছুরি, বটি, গামছা, প্লাস্টিকের বালতি, পলিথিন ইত্যাদির বিক্রিও বেড়ে যায়। বাসাবাড়ির পরিচ্ছন্নতা ও মাংস বহনের কাজেও অস্থায়ীভাবে অনেক শ্রমজীবী আয় করতে পারেন। এই মৌসুমে আয়ের যে সুযোগ তৈরি হয়, তা দেশের অগণিত প্রান্তিক মানুষকে স্বস্তি দেয়।

চামড়া শিল্পের জন্য কুরবানির মৌসুম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানিনির্ভর খাত চামড়াশিল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ কাঁচামাল আসে এই সময়। যদিও চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পাওয়া ও সঠিক সংরক্ষণের ঘাটতি মাঝে মাঝে এই খাতে সংকট তৈরি করে, তবুও এর সামগ্রিক আর্থিক গুরুত্ব অপরিসীম।

অনানুষ্ঠানিক হিসেবে ধারণা করা হয়, কুরবানিকে ঘিরে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। খামারি, ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, কসাই, চামড়া শ্রমিক—সব খাতেই এই মৌসুমি অর্থনীতির স্পর্শ পড়ে। এটি একটি “ঈদ-নির্ভর অর্থনৈতিক বুম”—যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে, নগরজীবনেও বাড়তি সক্রিয়তা আনয়ন করে।

সব মিলিয়ে, কুরবানি শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়—বরং তা এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুশীলন, আর একই সঙ্গে একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ইঞ্জিন। ইব্রাহিম (আঃ)-এর জীবন, তাঁর কুরবানি, এবং তাকওয়ার বার্তা আমাদের শেখায়—ত্যাগই মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ। আর কুরবানি আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিতে সেই ত্যাগের একটি বাস্তব রূপ, যেখানে অন্তরের বিশুদ্ধতা ও সমষ্টিগত কল্যাণ একে অপরকে সম্পূরক করে তোলে।


এই যুগে, যখন ধর্মের তাৎপর্য অনেক সময় বাহ্যিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন কুরবানির গভীর তাৎপর্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আত্মত্যাগ, তাকওয়া, এবং সামষ্টিক কল্যাণই ইসলামের মূল শিক্ষা। কুরবানি হোক না শুধু ছুরির কাজ নয়—হোক আত্মার ঘষামাজা, হোক সমাজের ভারসাম্য রক্ষার এক মর্যাদাপূর্ণ আয়োজন।




Saturday, 12 April 2025

কেন আরব নেতারা গাজার ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করছেন না

Picture: Arab Leaders (Internet)


গাজায় চলছে ২১ শতকের সবচেয়ে নিষ্ঠুর, নির্মম ও পরিকল্পিত গণহত্যা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের একটি সশস্ত্র অভিযানের জবাবে ইসরায়েল যে মাত্রায় সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা যে কোনো মানবিকতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না এই দমননীতি থেকে। হাসপাতাল, স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ও সেচ্ছাসেবী মানবাধিকার কর্মী, সবই ইসরায়েলি স্থলাভিজার এবং বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এটিকে এককথায় ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।


তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত গাজায় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার শিশু, ৩৯ হাজারের বেশি শিশু অনাথ, আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার, এবং গাজার ৯০ শতাংশ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত। এটি নিছক কোনো যুদ্ধ নয়; এটি একটি একতরফা হত্যাযজ্ঞ, যেখানে অস্ত্রহীন সাধারণ মানুষ একটি পরাশক্তিধর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিষ্ঠুর আক্রমণের শিকার।


এই বাস্তবতায় গোটা বিশ্ব যখন ন্যায় ও মানবতার পক্ষে রাস্তায় নেমেছে, তখন আরব বিশ্বের নিস্তব্ধতা অনেক বড় প্রশ্ন তুলে ধরেছে। ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে এতটাই দ্বিধান্বিত বা নিরুৎসাহী কেন আরব নেতারা?


বলা হয়, আরবরা আজ নির্লিপ্ত। কিন্তু ইতিহাসে এমনটা সবসময় ছিল না। ফিলিস্তিন প্রশ্নে আরব বিশ্বের একাধিকবার সশস্ত্র জড়িত থাকার প্রমাণ আছে। যেমন ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিসর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যৌথভাবে যুদ্ধ করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল সদ্য ঘোষিত ইসরায়েল রাষ্ট্রকে প্রতিরোধ করা এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।



১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকটে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল এক ধাক্কায় গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গোলান হাইটস দখল করে নেয়। ১৯৭৩ সালে ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে মিসর ও সিরিয়া আবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তবে প্রতিটি যুদ্ধেই দেখা গেছে একটি ব্যাপার—আরবদের মধ্যে নেতৃত্বের সংকট, কৌশলগত বিভ্রান্তি এবং পারস্পরিক আস্থাহীনতা। এসব দুর্বলতাই যুদ্ধগুলোকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারেনি।


বর্তমানে আরব রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান অনেকটাই বদলে গেছে। অধিকাংশ রাষ্ট্র এখন রাজতন্ত্র বা স্বৈরশাসনের আওতায় পরিচালিত হয়। এই সরকারগুলো তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অনেকাংশে নির্ভরশীল পশ্চিমা শক্তির উপর—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের।


যুক্তরাষ্ট্র আবার ইসরায়েলের প্রধানতম মিত্র। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়া মানেই যুক্তরাষ্ট্রকে বিরূপ করা। এটি আরব নেতাদের জন্য কৌশলগত ও রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে। এ কারণেই তারা মানবতা ও ন্যায়ের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিতে ভয় পান।


আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়ায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এই অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে এখনো তেলনির্ভর। ফলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিক্রিয়ার শঙ্কায় তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী নয়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইতিমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এমন অবস্থায় গাজা ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নেওয়া তাদের কূটনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।



হামাসকে ঘিরে আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে স্পষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব। মিশরের দৃষ্টিতে হামাস শুধু ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন নয়, বরং মুসলিম ব্রাদারহুড সংশ্লিষ্ট একটি চরমপন্থী গোষ্ঠী, যেটি তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও হামাসকে পুরোপুরি সমর্থন করে না। বরং তারা এই গোষ্ঠীকে ইরানঘনিষ্ঠ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। তাই গাজায় চলমান মানবিক সংকটে তারা এক ধরনের কৌশলগত নীরবতা বজায় রেখেছে—যাতে নিজেদের অভ্যন্তরে উত্তেজনা না বাড়ে এবং পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট না হয়।


আরব বিশ্বের বর্তমান সংকটে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাব। একদিকে কাতার, ইরান ও তুরস্কের মতো দেশগুলো হামাসকে প্রকাশ্যে সমর্থন করছে, অন্যদিকে সৌদি আরব, মিশর ও আমিরাত অনেকটাই নিরপেক্ষ কিংবা নীরব ভূমিকায় রয়েছে। এর পেছনে যেমন রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হিসাব, তেমনি রয়েছে জিওপলিটিকাল এবং অর্থনৈতিক চাপের বাস্তবতা।


এই বিভক্তির কারণে ফিলিস্তিন সংকটে আরব দেশগুলো একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে হাজির হতে পারছে না। অথচ ইতিহাস বলছে—যদি আরব রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে একজোট হতে পারত, তবে যুদ্ধ ছাড়া আরও অনেক কৌশলেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কার্যকর অবস্থান নেওয়া সম্ভব হতো।


প্রয়োজনে তারা সরাসরি যুদ্ধে না গিয়েও বেশ কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারত। যেমন—গাজায় জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা পাঠানো, আন্তর্জাতিক মহলে সংগঠিত কূটনৈতিক চাপ তৈরি করা, কিংবা ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করে একটি দৃঢ় বার্তা দেওয়া—এসব কিছুই তাদের হাতে ছিল। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব কোনোটিই তারা করছে না। এমনকি আরব লীগের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো অবস্থান বা পরিকল্পনা সামনে আসেনি।


২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর রিয়াদে আয়োজিত এক যৌথ আরব-ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে এই সংকটে একটি সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো কীভাবে এবং কোন কৌশলে এই সংকট মোকাবিলা করবে—সে বিষয়ে কোনও স্পষ্ট রূপরেখা বা ঐক্যমত্য গড়ে উঠেনি। সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে ইসরায়েলকে চলমান মানবিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করা হলেও, তাতে কার্যকর কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ বা কৌশলগত সিদ্ধান্ত উঠে আসেনি।


এর ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অবস্থানে পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ও ইরাক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করলেও, উপসাগরীয় আরব দেশগুলো, মিশর ও জর্ডান তাদের বক্তব্যে অনেক বেশি সংযত ও কৌশলগত অবস্থানে ছিল। এমনকি সিরিয়া ও জর্ডানের মতো দেশগুলো, যারা একসময় ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরব ছিল, তারাও এবার অনেক বেশি সতর্ক ও পরিমিত ভঙ্গিতে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করে।


এই মুহূর্তে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হোক বা ইউরোপ-আমেরিকার রাজপথ, সাধারণ মানুষ গাজার পক্ষে সোচ্চার। আফ্রিকার শহরগুলোতেও মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু আরব বিশ্বের নেতৃত্ব—যারা ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের পাশে থাকার দাবি করে—তারা এখন শুধু উদ্বেগ প্রকাশ করেই থেমে থাকছে। মানবতার কথা বললেও, বাস্তবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তারা নিচ্ছে না।


গাজায় একের পর এক হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র ধ্বংস হচ্ছে। পানি, বিদ্যুৎ, ওষুধ—সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ যেসব রাষ্ট্র এক সময় নিজেদের ‘উম্মাহ’র নেতা দাবি করত, সেই আরব রাষ্ট্রগুলো এখন চুপ। তারা বিবৃতি দিচ্ছে, তীব্র নিন্দা করছে, কিন্তু কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এটা শুধু কূটনৈতিক বা রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, এটা এক ধরনের নৈতিক পতনও।


নিজেদের স্বার্থ, নিরাপত্তা, অথবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ঠিক রাখার অজুহাতে আরব নেতৃত্ব যদি এক জাতির নিধনের সময় নিশ্চুপ থাকে, তাহলে সেটা শুধুই ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়—তারা নিজেদের ইতিহাসকেও প্রতারণা করছে। ফিলিস্তিন ইস্যু শুধু রাজনৈতিক সংকট নয়, এটা মানবিক সংকট। এই অবস্থায় নিরবতা মানে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সমর্থন।


আজকের আরব নেতৃত্ব হয়তো যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য শক্তিধর দেশের চাপ সামলে চলতে চায়, কিন্তু ইতিহাস এমন নিষ্ক্রিয়তাকে ক্ষমা করবে না। সাধারণ মানুষ যখন মৃত শিশুদের ছবি দেখে চোখের পানি ফেলছে, তখন আরব নেতাদের চুপ করে থাকা ভবিষ্যতের প্রজন্মের চোখে এক লজ্জাজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে।

Thursday, 2 January 2025

The Teacher-Student Centre: The Heartbeat of Dhaka University


At the heart of Dhaka University's campus, the Teacher-Student Centre, or TSC, stands as not just an architectural landmark. It is a cultural and extracurricular center, a student sanctuary, and a testament to Bangladesh's rich heritage and spirit of life and liberty.

Since its establishment in 1961, TSC has been the beating heart of university life, bringing students and teachers together into a space designed for growth, dialogue, festivals, culture, and unity.

The story of TSC is woven into the political, social, and historical context of Bangladesh. Built with funding from the Government of Pakistan and the Ford Foundation, the TSC complex occupies a historic site, formerly the grounds of the Sujatpur Palace, a Nawab's palace. TSC's proximity to Suhrawardy Udyan, once a racecourse ground and now one of Dhaka's largest public parks, echoes its deep connection with Dhaka's past.

TSC's architectural design is an inspired blend of modernist and traditional styles, created by Greek architect
Constantinos Doxiadis. In keeping with Bangladesh's climate and community-based culture, the building is arranged around open courtyards, gardens, and an artificial fountain, one side of which is covered with a butterfly canopy that helps keep the building cool even in Dhaka's intense summer heat.

To the east of the main TSC building is a small Greek tomb, built in 1915, with inscriptions in classical Greek. The monument offers a rare connection to Dhaka's multicultural past and is one of the last remnants of the city's small Greek community from the last century, adding historical depth to the TSC complex. Along with that, there are two old Hindu monasteries in the swimming pool site.

Beyond its architectural charm, TSC is cherished as a haven for students to take a break from academic life. Here, formal education is complemented by a vibrant cultural, social, and intellectual environment.

Various student organizations operate from TSC, including the Dhaka University Journalists Association, Dhaka University Scout Den, Dhaka University Debating Society, Dhaka University Film Society, Dhaka University Quiz Society, Dhaka University Photographic Society, Dhaka University Readers Association, Dhaka University Environment Society, Dhaka University Research Society, and others. Together, these groups create a sense of community and shared purpose, bringing students from diverse backgrounds together in collaboration and friendship.

After the building was established, every type of social and political movement, including the War of Independence and the July Uprising, became a meeting place where students, professors, and activists gathered to discuss and plan for the country's well-being. This legacy of resistance and unity still lives on, as students use the same space to discuss contemporary issues.

During national crises, such as the devastating floods of 1987 and Cyclone Sidor in 2007 and the recent country's worst floods in 2024, TSC became a rallying point for student-led mass relief efforts, organizing and distributing food, medical supplies, and other resources from this central location. TSC also serves as the headquarters of Badhan, a blood donation organization run by Dhaka University students who coordinate regular blood donation drives to support local hospitals.

Renowned for its cultural programs, TSC’s various organizations regularly organize exhibitions, film screenings, reunions of ex-students, poetry readings, and art competitions, creating an open platform for budding artists, poets, filmmakers, and activists. The largest Bengali film festival takes place here during the full month of the language movement, February. Here the central orientation of the novice students is arranged every year. 

On the front outside of TSC, you will find several types of tea rooms with various kinds of teas where students take the test of hot teas and enjoy their academic lives chatting with their friends. The teas here are very familiar to over the capital. If you are in the corridor of the TSC, you will see various types of groups of students who may be chatting, practicing songs and dances, taking preparation for their presentations and assignments, and so on.

On the backside of the swimming pool area, there is an open school run by the students for the facility-derived street children. It is one of the best vivid places in the Dhaka University campus and all over the city, which will not be able to be recognized and guessed without part of it.

The memories of university lives can be vague, but not the days of TSC for the students of the University of Dhaka.

Sunday, 7 July 2024

মহিয়সী ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী : নবাব, দানবীর, সাহিত্যিক ও সমাজহিতৈষী



পূর্ব বাংলায় মানব জীবনের অস্বিত্বের ইতিহাস বেশ পুরোনো এখানে এসে মিশে গেছে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা এবং দৈহিক ও মানসিক বৈচিত্রের মানুষ যারা এই অঞ্চলের মানুষের জীবনধারণ ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি মৌলিক কাঠামোতে অবদান রেখেছেতবে এই সমাজের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও শোষণ-নিপীড়নের বিপরীতে আজীবন কাজ করে যাওয়া মানবিক মানুষেসংখ্যা নেহায়েত কম না হলেও তাঁদের চর্চা নেহায়েত সামান্য যাঁদের মাঝে নারীদের সংখ্যা আরো হাতে গুণা কয়েকজন হলেও তাঁরা এদেশের নারী সমাজের সার্বিক উন্নতিও সামাজিক মুক্তির ব্যাপারে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন তবে, আজ আমরা কম বেশি পশ্চাত্যের মনীষীদের চর্চা করলেও আমাদের নিজেদের আপন মনীষীদের চর্চা করতে যেন ভুলেই বসেছি ! তেমনি একজন পর্দার আড়ালের পরে যাওয়া মহিয়সী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী।



জন্ম

বাংলার প্রথম এবং একমাত্র নারী নবাবফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর জন্ম ১৮৩৪ সালে কুমিল্লা জেলার হোমনাবাদ পরগনার (বর্তমানে লাকসামের) অন্তর্গত পশ্চিমগাঁও গ্রামের এক জমিদার বংশে  তাঁর বাবার নাম আহমদ আলী চৌধুরী এবং মায়ের নাম আফরান্নেছা চৌধুরাণী তাঁর পিতা ছিলেন ঐ অঞ্চলের জমিদার

শৈশব ও শিক্ষালাভ

তৎকালীন বাংলার সম্রান্ত জমিদার পরিবারে বেড়ে উঠা, ফয়জুন্নেসার শৈশব কেঁটেছে অন্য স্বাভাবিক দশটি বাচ্চা থেকে অনেকটা ভিন্নভাবে পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থেকে গৃহশিক্ষক উস্তাদ তাজউদ্দিন সাহেবের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন বিষয়ে দীক্ষা গ্রহণ করেন তিনি বাংলা, আরবি, ফারসি, উর্দু ও সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি জমিদারি পরিচালনার প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন

দাম্পত্যজীবন

১৮৬০ সালে ২৬ বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জমিদার মুহম্মদ গাজীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে তিনি ছিলেন মুহম্মদ গাজীর দ্বিতীয় স্ত্রী এবং এই সম্পর্ক মধুর না হওয়ায় স্বল্প সময়ে তাঁদের দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে

জমিদারি লাভ

১৮৮৩ সালে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করলে তিনি পশ্চিমগাঁও-এর জমিদারি লাভ করেন এর দুবছর পর ১৮৮৫ সালে মা-ও ইন্তেকাল করলে তিনি মাতুল সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হন। যার ফলে তিনি সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তির আসনে আবির্ভূত হন তিনি তাঁর দূরদর্শী চিন্তাধারা ও আধুনিক মননের সাহায্যে সেসময়কার সমাজের সকল বাঁধা বিপত্তিকে পাশকাঁটিয়ে নিজগুণে জমিদারি পরিচালনা করতে সমর্থ্য হয়েছেন

সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা

তিনি যে সময় ক্ষমতায় আসেন তখন বাংলা ও সমগ্র ভারতেই সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তনশীল অবস্থা বিরাজমান সিপাহী বিদ্রোহের পর একদিক থেকে ব্রিটিশ শাসনের মোড় পরিবর্তন অন্যদিক থেকে বাংলার পূনর্জাগরণের এক উত্তরণ কাল অতিবাহিত হচ্ছেএকই সাথে ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে সমাজে এক নতুন ভাবধারার পাশাপাশি দীর্ঘকাল যাবৎ প্রচলিত সামাজিক বিভিন্ন রীতিনীতি ও কুসংস্কারের বিপরীতে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি বিদ্যমান এছাড়াও আছে জোড়পূর্বক খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার অপচেষ্টা ও শিল্প বিপ্লবের অর্থিক ও সামাজিক প্রভাব

তবে এ অঞ্চলের বাস্তবতা ছিল আরো ভিন্ন বিশেষ করে সেসময় ইংরেজ শাসনে ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে মুসলমান জনগোষ্ঠীর হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ায় তারা নিজেদের অস্তিত্ব সংকটের ক্রান্তিকাল আতিবাহিত করছে, তখন ইংরেজি শিক্ষার বিপরীতে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহন করে তখন এই অঞ্চলের স্বাক্ষরতার হার ছিল প্রায় ২-% এর কোঠায়তীক্ষ দূরদর্শী চিন্তার অধিকারী নবাব তখনই অবলোকন করতে পেরেছিলেন যে, সার্বিক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন করতে গেলে শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের অবস্থার পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই


জনহিতকর কার্যাবলী  

জমিদারি লাভ করার পরেই সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রকে অগ্রাধিকারে রাখেনশিক্ষা ও সমাজ সচেতেন জমিদার ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী এ অঞ্চলকে এগিয়ে নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে ইংরেজি বা ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় তিনি পুরুষদের জন্য কয়েকটি বিদ্যালয় স্থাপনের পাশাপাশি ১৮৭৩ সালে তিনি নারীদের জন্যও একটি বিশেষায়িত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যার নামকরণ করা হয় নাম ‘ফয়েজুন্নেসা উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়’ যা শুধু এ অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানদের নয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য সর্ব প্রথম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। তিনি কেবল বিদ্যালয় স্থাপন করেননি পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের অগ্রগতির নিমিত্তেও কাজ করে গেছেন যখন ইংরেজি শিক্ষাকে ফিরিঙ্গিদের ভাষা বলা হতো কিংবা নিরূৎসাহী করা হতো কখন তিনি ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে জমিদারের তহবিল থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা করেন তাছাড়া তিনি ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বিস্তারে বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন

চিত্র : নওয়াব বাড়ীর সদর দরজার দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ সূত্র : ইন্টারনেট

শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামোগত উন্নতি সাধিত করেন তিনি ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে নারীদের জন্য ‘ফয়েজুন্নেসা জানানা’ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমান সময়ে ‘কুমিল্লা সদর হাসপাতালের নবাব ফয়জুন্নেসা ফিমেল ওয়ার্ড’ নামে পরিচিত। একইসাথে তিনি নিজ বাড়ির পাশে একটি মুসাফির খানা স্থাপন করেন যেখানে মুসাফিরদের জন্য তিনদিন তিনরাত্রি বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, যা আজও বিদ্যমান রয়েছে এছাড়াও তিনি সাধারণ জনগণের সুবিধার জন্য রাস্তাঘাট, দীঘি, পুল ইত্যাদি নির্মাণ করেন। নবাব বাড়ির সংলগ্ন ডাকাতিয়া নদীর উপর ‘সাবানী বা সাহেবানীর পুল’ নামে যে লোহার পুলটা আজও বিদ্যমান তা এই মহীয়সী নারীর সার্বিক তত্তাবধায়নে নির্মিত।

নবাব ফয়জুন্নেছা কেবল নিজ অঞ্চলেই কিংবা নিজ দেশের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন তা নয় তিনি নিজ অঞ্চলের বাইরেও মানবতার সেবায় অকাতরে দান করে গেছেন ১৮৯৪ সালে তিনি পবিত্র হজ্ব পালন করার উদ্দেশ্যে পবিত্র নগরী মক্কায় যান সেখানে হাজীদের কষ্ট লাগবের উদ্দেশ্যে একটি 'মুসাফিরখানাও প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুদান প্রদান করেছেন মৃত্যর আগে তিনি তাঁর সকল সম্পত্তি ওয়াকফ করে গেছেন

ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি সুষ্ঠভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করেছেন ইসলাম ধর্মের পর্দার বিধান তিনি লঙ্গণ করেছেন বলে তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর তিনি নিজের ধর্মের প্রশান্তির বাণী নিজের মাঝে ধারণ করার পাশাপাশি ধর্মের মহানোভবতার পরিচয় ব্যক্ত করে গেছেন

সম্মাননা

বৈচিত্রময় বর্ণাঢ়্য সংগামী জীবনে তিনি কয়েকটি পদবী ও সম্মাননা লাভের মাধ্যমে নিজকে স্বতন্ত্ররূপে পরিচিত করেছেন বাংলাপিডিয়ার মতে, " ফয়জুন্নেসার জনহিতৈষণার পুরস্কারস্বরূপ মহারানী ভিক্টোরিয়া ১৮৮৯ সালে তাঁকে 'নবাব' উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনিই বাংলার প্রথম মহিলা যিনি এই উপাধি লাভ করেন।" ফয়জুন্নেসার এই সম্মাননার জন্য তৎকালীন সময়ে ৩৫০০ হাজার টাবা খরচ করা হয়েছে বলে জানা যায় এছাড়াও, নবাব খেতাব পাওয়ার আগে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার বেগম উপাধি দিতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন

১৯৯৩ বাংলা একাডেমি ‘নবাব ফয়জুন্নেসা ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। যেখানে তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রির ছাত্রীদের আবাসিক সুবিধার জন্য নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর নামেনবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছাত্রীনিবাসএর যাত্রা শুরু করে ১৯৯৪ সালে এছাড়াও দেশের দুটি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে একটি করে ছাত্রী হল আছে ২০০৪ সালে তাঁর মৃত্যুর একশ বছর পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সমাজ সেবার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি স্বরূপ মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করেন

সাহিত্যচর্চা

সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়ও তাঁর পদচারণা ছিল অবিষ্মরণীয় তাঁকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে স্মরণ করা হয়  ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গিরিশচন্দ্র মুদ্রণ যন্ত্র থেকে শ্রীমতি নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী রচিত সাহিত্য গ্রন্থ ‘রূপজালাল' প্রকাশিত হয়। যা ছিল মুসলিম নারী রচিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম। এটি গদ্য ও পদ্য ছন্দে রচিত। যেখানে কিছু অংশে লেখকের জীবনে স্মৃতির উল্লেখ আছে এছাড়াও তাঁর আরো দুটি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়-সঙ্গীত লহরীসঙ্গীত সার প্রকাশিত হলেও তা এখন দুষ্প্রাপ্য রয়ে গেছে তিনি তৎকালীন বাংলা সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রভূমি কলকাতার সাহিত্য সমাজের সাথেও বিভিন্নভাগে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন তিনি কলকাতার ঠাকুরবাড়ির 'সখী সমিতি'র সদস্যও ছিলেন

তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত ঐতিহাসিক ‘সুধাকর’ পত্রিকার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। যা প্রগতিশীল তৎকালীন মুসলমান সমাজের মুখপাত্র হয়ে কাজ করেছে

প্রয়াণ

১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর (১০ আশ্বিন, ১৩১৪ বঙ্গাব্দ) এ মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে। তাঁকে স্বানর্মিত দশগুম্বুজ মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে নিজ কন্যা আরশাদুন্নেসার পাশে শায়িত করা হয়।

দায়িত্ব

নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী এমন একজন সমাজহিতৈষী, প্রজাদরদি, আধুনিক মানসিকার দৃঢ় ও কুসংস্কার বিরোধী সফল জমিদার ছিলন, যিনি প্রত্যেশাসকের জন্য বিভিন্ন ভাবে উদাহারণ হয়ে থাকবেন তাঁর ইন্তেকালের এত বছর পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আমরা যেভাবে তাঁর কাছে ঋণী কিংবা তাঁর উদ্দ্যোগে যে হারে উপকৃত সে হারে তুলনায় আমরা তাঁর চর্চা করছি অতি নগন্য তিনি যে আমাদের জাতির কত বড় একটা সম্পদ ও গর্বের বিষয় তা আজ আমরা জনিনা পাঠ্যপুস্তকসহ বিভিন্ন গনমাধ্যম ও প্রচারমূলক ব্যবস্থায় তাঁর কথা উল্লেখ্য হয় একথা বললে ভুর হবে প্রত্যেক জতির ভাগ্যেই কয়েকজন এমন মহান ব্যাক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায় যারা নিজের জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে অমরত্ব লাভ করেন এবং পরবর্তীকালে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য উদাহারণ হয়ে থাকে এবং তাদের জন্য দেশপ্রেম ও জীবনবোধের অনুপ্রেরণা যোগায়

তবে, আমাদের জাতি কি ঋণ পরিশোধে এতই কৃপণ যে, তাঁদের মতো মহীয়সীদের কথা নতুন প্রজন্মের জানা শোনা এত অপ্রতুল? নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, দর্শন ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের জ্ঞান ও সচেতেনতা বৃদ্ধি সরকার ও সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে তাঁদের নিয়ে গবেষণা, সেমিনার, চলচ্চিত্র, প্রবন্ধ, ফিচার ও প্রচার মূলক কাজ করার মাধ্যমে যেমন তাঁদেরকে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা যাবে ঠিক তেমনই তা প্রজন্মের হৃদয়ে সংরক্ষণের স্থান পাবে তাঁদের নিয়ে অনেক কাজ করার আছে বুদ্ধিভিত্তিক চর্চাই পারে একটি জাতির ভীত গড়ে দিতে  



কুরবানির আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য

ইসলামে কুরবানি কেবল একটি ধর্মীয় ইবাদত নয়, বরং এটি মানবজীবনের জন্য এক আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-...